
(চাঁদের মাসয়ালা পর্ব ৪)
হানাফী মাজহাবের প্রাচীন প্রাচীন ফকিহ্ ও মুজতাহিদগণের ফাতওয়া মোতাবেক উদয়াস্থলের ভিন্নতা হলে দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে রোজা ও ঈদ পালন করা যাবে না। নিচের দলিল গুলো লক্ষ্য করুন,
📖১.হানাফী মাজহাবের প্রাচীন ফকিহ্ ও মুজতাহিদ, ইমাম আবুল ফজল আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ আল-কিরমানী রহ. (ওফাত ৫৪৩ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
ولو الصماء اهل مصر ثلاثين يوما للرؤية وصام اهل بلد تسعة وعشرين يوما للرؤية فعلي هؤلاء قضاء يوم واحد، وهذا اذا كان بين البلدين تقارب لا تختلف المطالع، فان كان يختلف لم يلزم أحد البلدين حكم الأخر.
অর্থাৎ, যদি এক শহরবাসী তাদের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে ৩০টি রোজা রাখে এবং অপর শহরবাসী তাদের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে কোন ২৯টি রোজা রাখে, তাহলে তাদের ওপর একটি রোজা কাযা করা আবশ্যক হবে। এই বিধান ওই ক্ষেত্রেই হবে যখন দুই শহর কাছাকাছি হবে ও উদয়াস্থল ভিন্ন না হবে। আর যদি উদয়াস্থল আলাদা হয় তাহলে এক শহরের বিধান অন্য শহরের জন্য আবশ্যক হবেনা। (কিরমানী: আত-তাজরিদুর রুকনী, ১/৩৪০-৪১)
📖২. প্রখ্যাত মুজতাহিদ শামসুল আইম্মা মাহমুদ ইবনে আব্দুল আযিয ওয়াযজান্দি হানাফী রহ. (ওফাত ৫৬০ হি.) যিনি ইমাম কাজীখাঁন রহ. এর আপন পিতামহ (দাদা) ও উস্তাদ ছিলেন, তিনি এ বিষয়ে বলেছেন,
وسئل الأوزجندي عمن قال لصاحب الدين ان لم اقص حقك يوم العيد فكذا فجاء يوم العيد الا ان قاضي هذه البلدة لم تجعله عيدا، ولم يصل فيه صلاة العيد لدليل لاح عنده، وقاضي بلدة أخرى جعله عيدا قال اذا حكم قاضي بلدة بكونه عيدا يلزم ذلك اهل بلدة أخرى اذا لم تختلف المطالع كما في الحكم بالرمضانية.
অর্থাৎ, ইমাম ওয়াযজান্দিকে জিজ্ঞাসা করা হল, কেউ তার ঋণদাতাকে বলল, ঈদের দিন তোমার ঋণ আদায় না করলে এই হবে (কোনো কসম করল)। এখন ঈদ এমন হল যে, ওই ব্যক্তি যে শহরের অধিবাসী সেখানের কাজী কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে ঈদের ঘোষণা করতে বিরত থাকলো ও ঈদের নামাজ আদায় করা থেকে বিরত থাকলো, কিন্তু অন্য কোন শহরের কাজী ঈদ ঘোষণা করল (তাহলে কোন দিন ঈদের দিন হিসেবে গণ্য হবে এবং ঐ লোকের কি হবে?)।
ওয়াযজান্দি রহ. বলেন, উপরোক্ত দুই শহরের উদয়াস্থল যদি অভিন্ন হয়, তাহলে এক শহরের কাজীর ঘোষণা অন্য শহরের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় হবে, যেমনটা রমজান মাসের ব্যাপারে বিধান রয়েছে। (ইবনু নুযাইম: বাহরুর রায়েক, ৪/৩৯৮)
📖৩. ইমাম কিরমানী রহ. এর অন্যতম ওস্তাদ কাজিউল কুজাত শাইখুল ইসলাম ইমাম জামাল উদ্দিন আল-মুতাহহির ইয়াযদী হানাফী রহ. (ওফাত ৫৫৯ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
لو صام اهل بلد تسعة وعشرين واهل بلدة ثلاثين ان كان تختلف المطالع لا يلزم احدهما حكم الأخر، وان كان لا تختلف المطالع يلزم.
অর্থাৎ, যদি এক শহরবাসী ২৯টি রোজা রাখে এবং অপর শহরবাসী ৩০টি রোজা রাখে এবং দুই শহরের উদয়াস্থল ভিন্ন হয় তাহলে এক শহরবাসীর জন্য অপর শহরবাসীর চাঁদ দেখার হুকুম আবশ্যক হবেনা। আর যদি উভয় শহরবাসীর উদয়াস্থল ভিন্ন না হয়, তাহলে এক শহরের হুকুম অপর শহরবাসীর জন্য আবশ্যক হবে। (ইয়াযদী: জাওয়াহিরুল ফাতওয়া, ৩২-৩৩ পৃ.)
📖৪. হানাফী মাজহাবের আরেকজন প্রাচীন ফকিহ্ ও মুজতাহিদ ইমাম সিরাজউদ্দিন আবি মুহাম্মদ আলী ইবনে উসমান আল-আউশী রহ. (ওফাত ৫৬৯ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
اهل بلدة صاموا للرؤية ثلاثين يوما، واهل بلدة أخرى تسعة وعشرين يوما للرؤية، فعلي هؤلاء قضاء يوم الا اذا كان بين البلدتين تباين بحيث تختلف المطالع.
অর্থাৎ, এক শহরের অধিবাসী চাঁদ দেখে ৩০টি রোজা রাখল আর অন্য শহরের অধিবাসীগণ চাঁদ দেখেই ২৯ টি রোজা রাখল, তাহলে তাদেরকে একদিনে রোজা কাযা করতে হবে। তবে যদি দুই শহরের মাঝে উদয়াস্থলের পার্থক্য না হয় তাহলে কাযা করতে হবে না। (ফাতওয়ায়ে সিরাজিয়্যা, ১৬৯ পৃ.)
📖৫. হানাফী মাজহাবের মালিকুল ওলামা প্রখ্যাত ফকিহ্ ও মুজতাহিদ ইমাম আলাউদ্দিন আবু বকর ইবনু মাসউদ কাসানী রহ. (ওফাত ৫৮৭ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
اذا كان المسافة بين البلدين قريبة لا تختلف فيها المطالع فاما اذا كانت بعيدة فلا يلزم أحد البلدين حكم الأخر.
অর্থাৎ, যখন দুটি দেশের দূরত্ব খুব নিকটবর্তী হবে ও চাঁদের উদয়াস্থলের কোনো ভিন্নতা থাকবেনা (তখন এক শহরের হুকুম আরেক শহরের জন্য আবশ্যক হবে)। আর যখন দূরবর্তী কোনো দেশ হবে তখন এক দেশের চাঁদ দেখা অন্য দেশের জন্য রোজা ও ঈদ পালন আবশ্যক হবে না। (কাসানী: বাদাইয়ূস সানাঈ, ২/২২৪)
📖৬. আসহাবুত তারজীহ স্তরে মুজতাহিদ ও প্রখ্যাত হেদায়া গ্রন্থাকার ইমাম বুরহান উদ্দিন আলী ইবনে আবি বাকর আল মুরগিনানী রহ. (ওফাত ৫৯৩ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
وهذا اذا كان بين البلادين تقارب بحيث لا تختلف المطالع فان كان يختلف لا يلزم احد البلدين حكم الاخر.
অর্থাৎ, এই বিধান ওই ক্ষেত্রেই হবে যখন দুই শহর কাছাকাছি হবে ও উদয়াস্থল ভিন্ন হবে না, আর যদি উদয়াস্থল আলাদা হয় তাহলে এক শহরের বিধান অন্য শহরের জন্য আবশ্যক হবেনা। (মুরগিনানী: আত-তাজনীস ওয়াল মুজিদ, ২/৪২৩)
📖৭. হানাফী মাযহাবের প্রাচীন আরেকজন ফকিহ্ ও মুজতাহিদ, ইমাম জয়নুদ্দিন আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবি বাকার আর-রাজি রহ. (ওফাত ৬৬৬ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
تعدد المطالع ولا يلزم أحد المصرين وؤية المصر الآخر الا اذا اتحدت المطالع.
অর্থাৎ, এক শহরবাসীর জন্য অন্য শহরবাসী চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে রোজা আবশ্যক হবেনা, তবে হ্যাঁ যদি একই উদয়াস্থলের অনুসারী হয় তাহলে হবে। (তুহফাতুল মুলক, ১/১৩৮)
📖৮. হানাফী মাজহাবের আরেকজন প্রাচীন ফকিহ্ ও মুজতাহিদ, ইমাম আবুল ফজল আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ হানাফী রহ. (ওফাত ৬৮৩ হি.) বলেছেন,
اذا صام اهل مصر ثلاثين يوما برؤية واهل مصر اخر تسعة وعشرين يوما برؤية، فعليهم قضاء يوم ان كان بين المصرين قرب بحيث تتحد المطالع، وان كانت بعيدة بحيث يختلف لا يلزم احد المصرين حكم الاخر.
অর্থাৎ, যখন এক শহরবাসী চাঁদ দেখে ৩০টি রোজা রাখে এবং অপর শহরবাসী চাঁদ দেখে ২৯টি রোজা রাখে, তখন তাদের উপর আরেকটি রোজা রাখা আবশ্যক হবে, তবে যদি শহর দুটি নিকটবর্তী অঞ্চলে হয়। আর যদি দূরবর্তী অঞ্চল হয় ও সেখানে উদয়াস্থলের ভিন্নতা হয়, তখন এক শহরের হুকুম অপর শহরের জন্য আবশ্যক হবে না। (আল-ইখতিয়ার লি'তালিলিল মুখতার, ১/১২৯)
📖৯. হানাফী মাজহাবের প্রখ্যাত মুজতাহিদ ইমাম উসমান ইবনু আলী ফখরুদ্দিন যায়লায়ী রহ. (ওফাত ৭৪৩ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
فان كان بينهما تقارب بحيث لا تختلف المطالع يجب وان كان بحيث يختلف لا يجب واكثر المشايخ على انه لا يعتبر حتى اذا صام اهل بلدة ثلاثين يوما واهل بلده اخرى تسعة وعشرين يوما يجب عليهم قضاء يوم، والأشبه ان يعتبر لان كل قوم مخاطبون بما عندهم وانفصال الهلال ان شعاع الشمس يختلف باختلاف الاقطار،
অর্থাৎ, যদি দুইটি শহরের দূরত্ব কম হয়, তখন এক শহরে চাঁদ দেখার উপর অপর শহরে রোজা রাখা আবশ্যক হবে, আর যদি উদয়াস্থল ভিন্ন হয় তাহলে আবশ্যক হবেনা। অধিকাংশ মাশাইখ বলেছেন, উদয়াস্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য নয়, এমনকি এক শহরবাসী ৩০টি রোজা রাখলে ও অপর শহরবাসী উন্নয়ন ২৯টি রোজা রাখলে তাদের উপর একটি রোজা কাযা করা আবশ্যক হবে। অধিক গ্রহণযোগ্য মত এই যে, স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখার সংবাদের ভিত্তিতে রোজা ও ঈদ উদযাপন করবে, কেননা প্রতিটি অঞ্চলের অধিবাসী তাদের উদয়স্থলের উপর আমল করার প্রতি আদিষ্ট হয়েছে, উদয়াস্থলের পার্থক্যের কারণে সূর্যের আলোক রশ্মি থেকে চাঁদ আলাদা হয়ে থাকে। (যায়লায়ী: তাবইনুল হাকাইক, ১/৩২১)
📖১০. হানাফী মাজহাবের আরেকজন বিখ্যাত ফকিহ্ ও মুজতাহিদ, ইমাম আবদুল লতিফ ইবনে আব্দিল আযিয ইবনে আমিনুদ্দিন ইবনে মালাক আল-কিরমানী রহ. (ওফাত ৮০১ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
هذا اذا كان بينهما تقارب في مطلع هذا هو الآشبه.
অর্থাৎ, এই বিধান ওই ক্ষেত্রেই যখন দুই শহরের উদয়াস্থল ভিন্নতা হবেনা, আর এটি অধিক যুক্তিযুক্ত ফাতওয়া। (শারহুল মাজমা' লি'ইবনে মালাক, ৬৩ পৃ.)
📖১১. হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকিহ্ ও মুজতাহিদ, ইমাম কাজী মুহাম্মদ ইবনু ফারামুজ মোল্লা খসরু রহ. (ওফাত ৮৮৫ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
واما على قول ما اعتبره ينظر ان كان بينهما تقارب بحيث لا تختلف المطالع يجب وان كان بحيث يختلف لا يجب. واكثر المشايخ على انه لا يعتبر، قال الزيلعي والاشبه ان يعتبر.
অর্থাৎ, যারা উদয়াস্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য বলেছেন তাদের বক্তব্য হলো, যদি দুইটি শহর নিকটবর্তী হয় যেখানে উদয়াস্থলের ভিন্নতা হয় না, তাহলে এক শহরের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে অপর শহরে রোজা রাখা আবশ্যক হবে, কিন্তু উদয়াস্থলের ভিন্নতা হলে আবশ্যক হবে না। অধিকাংশ মাশায়িখ বলেছেন, উদয়াস্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। ইমাম যায়লায়ী রহ বলেছেন, অধিক যুক্তিযুক্ত কথা হল উদয়াস্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য। (দুরারুল হাকাম শারহু গুরারিল আহকাম, ১/২০১)
হানাফী মাজহাবের আরো বহু সংখ্যক মুজতাহিদ ইমামগণের মতামত রয়েছে। যার দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, উদয়াস্থলের ভিন্না হলে দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে রোজা ও ঈদ পালন করা যাবে না।
মহান আল্লাহ তা'আলা সবাইকে বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুক, আমিন।
✍️অধম- মুফ্তী মুহাম্মদ আলাউদ্দিন জেহাদী
খাদেমঃ বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আটরশি পাক দরবার শরীফ, ফরিদপুর।
0 মন্তব্যসমূহ