
(চাঁদের মাসয়ালা পর্ব ৩)
হানাফী মাজহাবের প্রাচীন মুজতাহিদগণের ফাতওয়া মোতাবেক উদয়াস্থলের ভিন্নতা হয় এমন দূরবর্তী স্থানের চাঁদ দেখার উপর আমল করা জায়েয নয়।
📖১. ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. (ওফাত ১৫০ হি) এর ফাতওয়া বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইমাম মুহাম্মদ ইবনু হাসান রহ. (ওফাত ১৮৯ হি.) কর্তৃক লিখিত জাহিরুর রেওয়ায়েতের ৬ কিতাবের প্রধান ও প্রথম কিতাব হল 'আল-মাবসুত', সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে,
أرأيت اهل مصر صاموا شهر رمضان لغير رؤيته وفيهم رجل لم يصم معهم حتى رأى الهلال من الغد فصام أهل ذلك المصر ثلاثين يوما وصام رجل تسعة وعشرين يوما ثم افطروا جميعا لرؤيته قال ليس علي الرجل قضاء ذلك اليوم الذي صامه أهل مصره لانهم ام يصوموا لرؤية الهلال.
অর্থাৎ, এক শহরবাসী চাঁদ না দেখে সবাই রোজা রাখল কিন্তু তাদের মাঝে একজন লোক রোজা রাখল না (চাঁদ না দেখার কারণে)। এমনকি পরেরদিন চাঁদ দেখা গেল, ফলে এই শহরবাসী ৩০ টি রোজা রাখল, কিন্তু ওই লোকের ২৯ টি রোজা হল, অতঃপর সবাই একসাথে চাঁদ দেখে রোজা ভাঙলো। ইমাম মুহাম্মদ রহ. বলেন, ওই লোকের জন্য একটি রোজা কাজা করা আবশ্যক নয়, কারণ শহরবাসী তাদের চাঁদ দেখার মাধ্যমে রোজা রাখেনি। (আল-মাবসুত, ২/২১০)
সুতরাং প্রত্যেক উদয়াস্থালের লোকজন তাদের নিজেদের চাঁদ দেখার উপর আমল করলে সম্পূর্ণ জায়েয হবে।
📖২. হানাফী মাজহাবের প্রাচীন মুজতাহিদ ইমাম আবুল হাসান কারখী রহ. (ওফাত ৩৪০ হি.) বলেছেন,
قال وان صام اهل بلد ثلاثين يوما لرؤية وصام اهل بلد تسعة وعشرين يوما لرؤية فعليهم قضاء يوم، وذلك لان الذي صاموا ثلاثين يوما قد رأوا الهلال قبل هؤلاء بليلة، والعمل علي قول من رأى دون من نفى الرؤية، وهذا اذا كان بين البلدين تقارب لا تختلف فيه مطالع الهلال.
অর্থাৎ, ইমাম আবুল হাসান কারখী রহ. বলেছেন, যখন এক শহরবাসী তাদের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে ৩০টি রোজা রাখবে এবং অপর শহরবাসী তাদের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে ২৯টি রোজা রাখবে, তখন দ্বিতীয় শহরবাসীর জন্য একটি রোজা কাজা করা আবশ্যক হবে, কারণ প্রথম শহরবাসী তাদের একরাত পূর্বে চাঁদ দেখেছে। আর আমল করা হবে যারা চাঁদ দেখেছে তাদের উপরে, যারা চাঁদ দেখেনি তাদের উপর নয়। আর এটি যখন দুটি শহরের দূরত্ব নিকটবর্তী হবে তখন, যেখানে নবচন্দ্রের উদয়াস্থলের ভিন্নতা হয়না। (মুখতাছারুল কারখী, ৩১ পৃ.)
📖৩. হানাফী মাজহাবের প্রাচীন ফিকহ্ ও মুজতাহিদ ইমাম আবু বকর আহমাদ ইবনু আলী আর-রাজী আল-জাসসাস রহ. (ওফাত ৩৭০ হি.) বলেছেন,
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته. ويدل عليه اتفاق الجميع علي أن علي اهل كل بلد أن يصوموا لرؤيتهم وأن يفطروا لرؤيتهم، وليس عليهم انتظار رؤية اهل بلده دون غيرهم من اهل سائر الآفاق، فثبت بذلك أن كلا منهم مخاطب برؤية اهل بلده دون غيرهم.
অর্থাৎ তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গ। সকল ফকীহগণ ঐকমত্য হয়ে এটি দ্বারা দলিল পেশ করেন যে, নিশ্চয়ই প্রত্যেক শহরবাসী তাদের নিজেদের চাঁদ দেখার মাধ্যমে রোজা রাখবে এবং নিজেদের চাঁদ দেখার মাধ্যমে রোজা ভাঙবে, এতে সারা পৃথিবীর কারো জন্য অপেক্ষা করবে না। ফলে এটি দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রত্যেক শহরবাসী তাদের নিজেদের চাঁদ দেখার উপর মুখাপেক্ষী, অন্য শহরবাসীদের মুখাপেক্ষী নয়। (আহকামুল কোরআন লি'জাসসাস, ১/৩০৫)
📖৪. হানাফী মাজহাবের প্রাচীন ফিকহ্ ও তৃতীয় তবকার মুজতাহিদ ইমাম আবুল হাসান কুদুরী রহ. (ওফাত ৪২৮ হি.) তদীয় বলেছেন,
فأما اذا بعدا كثيرا لم يلزم اهل أحد البلدين حكم أخر، لان مطالع البلاد تختلف.
অর্থাৎ, যখন দুটি শহরের দূরত্ব এমন দূরত্বে হবে যেখানে নবচন্দ্র উদয়াস্থলের ভিন্নতা হবে তখন এক এলাকার চাঁদ দেখার উপর অন্য এলাকার রোজা রাখা আবশ্যক নয়, কেননা শহরসমূহে উদয়াস্থলের ভিন্নতা হয়। (শারহু মুখতাছারিল কারখি, ২/৩৮৩)
📖৫. শামসুল আইম্মা ইমাম সারাখছীর রহ. এর শাগরীদ, হাফিজুল হাদিস ও হানাফী মাজহাবের প্রাচীন ফকিহ্, ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইব্রাহিম আবু বকর আল-হাশিরী বুখারী রহ. (ওফাত ৫০০ হি.) বলেছেন,
وهذا اذا تقارب مطالع البلدين أما اذا تباعدت ليس لثاني ان يقضى قضاء الأول في اهل مصره،
অর্থাৎ, (পার্শ্ববর্তী এলাকার চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে রোজা রাখার) এই মাসয়ালা হলো যখন দুটি শহর নিকটবর্তী হবে, আর যদি দুটি শহর অনেক দূরবর্তী হয় তাহলে দ্বিতীয় শহরের জন্য প্রথম শহরের চাঁদ দেখা গ্রহণযোগ্য হবে না। (মুরগেনানী: আত-তাজনীছ ওয়াল মুজিদ, ২/৪২৩)
📖৬. ইমাম কাজীখাঁন রহ. এর পূর্বের হানাফী মাজহাবের আরেকজন ফকিহ্ ও মুজতাহিদ ইমাম আবুল ফাতাহ জহিরুদ্দিন আব্দুর রশিদ আল-ওয়ালওয়ালিযিয়্যা রহ. (ওফাত ৫৩০ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
هذا اذا كان بين البلدين تقارب بحيث لا تختلف المطالع، فان كانت تختلف لا يلزم أحد من البلدتين حكم الاخر.
অর্থাৎ, (পার্শ্ববর্তী এলাকায় চাঁদ দেখে রোজা রাখার) এই বিধান ওই ক্ষেত্রেই হবে যখন দুই শহর কাছাকাছি হবে, আর যদি উদয়াস্থল আলাদা হয় তাহলে এক শহরের বিধান অন্য শহরের জন্য আবশ্যক হবেনা। (ফাতওয়া ওয়ালওয়ালেযিয়্যা, ১/২৩৬)
📖৭. হানাফী মাজহাবের আরেকজন প্রাচীন মুজতাহিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ সমরকান্দী রহ. (ওফাত ৫৩৫ হি.) বলেছেন,
سئل شيخ الاسلام ابو الحسن عن قاضي برؤية هلال رمضان بشهادة شاهدين عند الاشتاه في مصر هل يظهر حكمه في حق مصر اخر؟ فقال: لا، لانه ليس تبعا له، بخلاف قرى هذا المصر ومحاله وما ينسب اليه.
অর্থাৎ, শাইখুল ইসলাম ইমাম আবুল হাসান রহ.কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কাজীর দরবারে রমজান মাসের চাঁদ দেখার দুইজন সাক্ষীর ব্যাপারে কোন শহরে হুকুম জারি হলে, ওই শহরের চাঁদ দেখার হুকুম কি অন্য শহরে বর্তাবে? তিনি বললেন: না, কেননা ওই শহরের লোকেরা এটির মুখাপেক্ষী নয়, তারা এই শহরে বসবাস করে এবং তারা এই শহরের অধীনস্থ হবে। (দাউদ ইবনু ইউসুফ: ফাতাওয়ায়ে গিয়াছিয়্যা, ৫০ পৃ.)
📖৮. হেদায়া গ্রন্থাকারের অন্যতম উস্তাদ হানাফী মাজহাবের প্রাচীন মুজতাহিদ ইমাম আবুল হাফস উমর ইবনু আব্দিল আযিয হুসামুদ্দিন শহিদ রহ. (ওফাত ৫৩৬ হি.) বলেছেন,
هذا اذا كان بين البلدين تقارب بحيث لا تختلف المطالع، وان كانت تختلف لا يلزم اهل أحد من البلدتين حكم أخر.
অর্থাৎ (পার্শ্ববর্তী এলাকায় চাঁদ দেখে রোজা রাখার) এই বিধান ওই ক্ষেত্রেই হবে যখন দুই শহর কাছাকাছি হবে, উদয়াস্থল আলাদা হলে এক শহরে বিধান অন্য শহরের জন্য আবশ্যক হবেনা। (আল-ফাতওয়াল কুবরা, ১৬ পৃ. মাখতুতা)
📖৯. হানাফী মাজহাবের আরেকজন প্রাচীন মুজতাহিদ ইমাম আবুল হাফস নাজিমুদ্দিন উমর ইবনু মুহাম্মদ নাসাফী রহ. (ওফাত ৫৩৭ হি.) বলেছেন,
سئل عن قضاء القاضي برؤية هلال شهر رمضان بشهاده شاهدين عند الأشتباه في مصر هل يجوز لأهل مصر أخر العمل بحكمهم؟ فقال: لا، ولا يكون مصر أخر تبعا لهذا المصر، انما سكان هذا المصر وقراها يكون تبعا له.
অর্থাৎ, প্রশ্ন করা হলো, দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে রমজান মাসের চাঁদ দেখার বিষয় বিচারকের রায় সম্পর্কে অন্য শহরবাসীর জন্য ওই শহরের বিধান মান্য করা জায়েজ হবে? তিনি বললেন: না। এই শহরবাসী অন্য শহরের অনুসারী হবে না, তারা এই শহরে বসবাস করে এবং তারা এই শহরের অধীনস্থ হবে। (ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া, ২/৯৬)
📖১০. হেদায়া গ্রন্থাকারের অন্যতম উস্তাদ, হানাফী মাজহাবের আরেকজন প্রাচীন মুজতাহিদ বুরহানুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ রফিউদ্দিন সারাখছী রহ. (ওফাত ৫৪৪ হি.) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
وهذا اذا كان بينهما تقارب حيث لا تختلف فيه مطلع الهلال، لان الرؤية لا تقارب ولا تختلف فيلزم احدهما حكم الاخر، وان كان بينهما مسافه مزيدة بحيث يختلف فيها المطالع لا يلزم احدهما حكم الاخر.
অর্থাৎ, এই বিধান ওই সময় প্রযোজ্য যখন দুই শহর কাছাকাছি হয়, যদ্ধারা চাঁদের উদয়াস্থল অভিন্ন থাকে।কারনে এ অবস্থায় তো চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে কোন ভিন্নতা হয়না। তাই এক শহরের বিধান অপর শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি দুই শহরের মাঝে দূরত্ব বেশি হয় যদ্বারা তাদের উদয়াস্থল আলাদা হয়ে যায় তাহলে এক শহরের হুকুম অপর শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে না। (আল-মুহিতুস সারাখছী, ১৯১-১৯২ পৃ.)
অতএব, হানাফী মাজহাবের প্রাচীন প্রাচীন মুজতাহিদগণের ফাতওয়া মোতাবেক উদয়াস্থলের ভিন্নতা হয় এমন দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখার উপর আমল করা জায়েয নয়। তৎকালীন সময়ে এই ফাতওয়ার বিপক্ষে কেউ ছিলনা। শতাব্দীর পর শতাব্দী এভাবেই আমল হয়ে আসছে।
মহান আল্লাহ তা'আলা সবাইকে বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুক, আমিন।
অধম- মুফ্তী মুহাম্মদ আলাউদ্দিন জেহাদী
খাদেমঃ বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আটরশি পাক দরবার শরীফ, ফরিদপুর।
0 মন্তব্যসমূহ